২ ডিসেম্বর ২০১৭ পার্বত্য
চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তি, রাজধানীসহ তিন পার্বত্য জেলায় ব্যাপক সমারোহে উদযাপনের
প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন ও
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদের উপনেতা আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ
ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে
এ চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বা শান্তিচুক্তি নামে খ্যাত। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে
শান্তিবাহিনীর সদস্যদের একাংশ অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার মাধ্যমে
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিবদমান দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের যবনিকাপাতের সূচনা হয় এবং
পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের দ্বার অবারিত হয়। যার প্রক্রিয়া এখনো চলমান।
একক ব্যক্তি বা একক সরকারের কৃতীত্ব নয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম পার্বত্য
অঞ্চলের বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিরসনে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সংলাপের সূচনা
করেছিলেন। তার সময়ের প্রধানমন্ত্রী মশিউর রহমানসহ আরো কয়েকজনের সাথে সফল আলোচনা হয়েছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে এরশাদ আমলে ৬টি, বেগম খালেদা জিয়া সরকারের প্রথম আমলে ১৩টি
ও শেখ হাসিনা সরকারের সাথে ৭টি মিলে মোট ২৬টি সংলাপের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত
হয়েছে।’ সন্তু লারমার এ দাবির মাধ্যমে বোঝা যায়, শান্তিচুক্তি ছিলো একটি জাতীয় আকাঙ্ক্ষা,
যা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে জিয়াউর রহমান ও খালেদা
জিয়া শান্তিচুক্তির চেষ্টা চালালেও ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করেছিল বিএনপি
নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় বিরোধী জোট। তারা এটিকে দেশ বিক্রির চুক্তি আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে
প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং তারা ক্ষমতায় গেলে এ চুক্তি বাতিল করা হবে বলেও ঘোষণা
দিয়েছিলেন। যদিও ক্ষমতায় গিয়ে খালেদা জিয়া এ নিয়ে তেমন উচ্চ্যবাচ্য করেননি। বরং নীরবে
শান্তিচুক্তির উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো বাস্তবায়ন করেছিলেন। অন্যদিকে শান্তিচুক্তির ধারাবাহিকতায়
১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র সমর্পণ করে সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জনসংহতি
সমিতি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিলেও জেএসএসেরই আরেকটি
অংশ প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে শান্তিচুক্তিকে প্রতারণামূলক ও প্রহসন আখ্যা দিয়ে
এর বিরোধিতা করে কালো পতাকা দেখিয়ে অস্ত্র সমর্পণে বিরত থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে
১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্ত¡শাসনের দাবিতে ইউনাইটেড
পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) গঠিত হয়। শুরু হয় সন্তু ও প্রসীতের নেতৃত্বে দুই
সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই।
পাশাপাশি সংশোধন দাবি করে আসছে। তার ভাষায়, ‘সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি
কেবল ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত লিখিত নয়- এর বাইরেও অনেকগুলো বিষয়ে সরকারের
সঙ্গে অলিখিত চুক্তি হয়েছে।’ সন্তু লারমা সবসময় এ অলিখিত চুক্তি বাস্তবায়নের উপরে বেশি
জোর দিয়েছেন। শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে গৃহযুদ্ধ হ্রাস পাওয়ায়
দেশি-বিদেশি অর্থায়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন
কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ, শিক্ষা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন,
অর্থনৈতিক, সামাজিক, কর্মসংস্থান, বনায়ন, পর্যটন, শিল্পায়ন, যোগাযোগ ও প্রযুক্তিসহ
প্রভৃতি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
স্বাক্ষরের পর ১৭৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ/পুনঃনির্মাণ/সংস্কার করা হয়েছে। অপর
এক তথ্যে জানা গেছে, আশির দশকে যেখানে উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১১টি,
সেটা এখন ৪৭৯টি; প্রায় প্রতিটি পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষার হার ২ শতাংশ থেকে
বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪৪.৬২ শতাংশে এ পৌঁছেছে। যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষার হার
৫৯.৮২ শতাংশ, সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ এবং
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের শিক্ষার হার ২৩% (সূত্র: বাংলাদেশ আদমশুমারী-২০১১)। এছাড়াও, পার্বত্য চট্টগ্রামে কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১টি থেকে
৩টি করা হয়েছে, হাসপাতালের সংখ্যা ৩টি থেকে ২৫টিতে উন্নীত হয়েছে। যেখানে খেলার কোনো
মাঠ ছিলো না বর্তমানে সেখানে ৫টি স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে। কলকারখানা, ক্ষুদ্র কুটির
শিল্প ১৯৩টি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১৩৮২টিতে উন্নীত হয়েছে। রাঙামাটিতে ১টি মেডিকেল কলেজ,
১টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বান্দরবানেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ক্ষেত্রে উপজাতীয় কোটা বলবৎ রয়েছে। সাজেক, নীলগিরি, নীলাচল, আলুটিলা, লেক ভিউ আইল্যান্ড, আরণ্যক
কমপ্লেক্সের মতো দেশের সেরা পর্যটন স্পট তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও বেসরকারি বিনিয়োগে
তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য পর্যটন রিসোর্ট, হোটেল প্রভৃতি।
শান্তিচুক্তি পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩০টির বেশি দেশি-বিদেশি এনজিও স্থানীয় জনগণের
জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ইউএনডিপি বিগত ১০ বছরে ১ হাজার
২০০ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করেছে। বর্তমানে সংগঠনটি ৭ বছর মেয়াদি ২ হাজার কোটি টাকার আরেকটি
প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ করে ইতোমধ্যে পাহাড়ের সব উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন
পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগের আওতায় আনা হয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলে স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালে মাত্র
৪৮ কি.মি. রাস্তা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্যাঞ্চলে
নির্মাণ করেছে প্রায় ১৫৩৫ কি.মি. রাস্তা, অসংখ্য ব্রিজ ও কালভার্ট। পার্বত্য চট্টগ্রাম
বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রদত্ত তথ্যে জানা গেছে, পার্বত্যাঞ্চলে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরোত্তর
৪০৪ কি.মি. এর অধিক রাস্তা ও গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সেতু সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং
কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন কর্তৃক নির্মাণ করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি-সাজেক, বান্দরবান-আলীকদমের
মতো উচুঁ ও দুর্গম এলাকায় সড়ক নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আরো ১০৫ কি.মি. সড়ক
নির্মাণাধীন রয়েছে এবং প্রায় ৮৬০ কি.মি. রাস্তা নির্মাণ পরিকল্পনায় রয়েছে। পাশাপাশি
পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি স্থল বন্দর নির্মাণ এবং টেলিযোগাযোগের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে
বাণিজ্য এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ভারতের মিজোরামের সাথে
রাঙামাটির থেগামুখ স্থল বন্দর হয়ে এবং বান্দরবান হয়ে মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগে সড়ক
নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলে ৪৭৯ কি.মি. অরক্ষিত সীমান্ত নিরাপত্তার
আওতায় আনার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ২৭১ কি.মি. ব্যাপী ৩৫টি নতুন বিওপি স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়াও আরো ১৭টি বিওপি স্থাপন প্রক্রিয়াধীন। এতে অতিরিক্ত ৯০ কি.মি. সীমান্ত নিরাপত্তার
আওতায় আসবে।
(১১ কেভি), ১ হাজার ৩৫৫ কি.মি. (৪ কেভি) বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সর্বমোট ৩৫%
লোক গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ পাচ্ছে। তাছাড়া সোলার প্যানেলের মাধ্যমে ৫ হাজার ৫০ বাড়িতে
বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলার সকল বাড়িতে বিদ্যুৎ
সরবরাহের নিমিত্তে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির
আওতায় তিন পার্বত্য জেলায় ৪১ হাজার ৮৪৭ জনকে বয়স্ক ভাতা, ২২ হাজার ৪১০ জনকে বিধবা ভাতা,
৭ হাজার ৩১১ জনকে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা এবং ৯৮১ জন প্রতিবন্ধীকে শিক্ষা উপবৃত্তি
প্রদান করা হয়েছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় এ অঞ্চলে ১ হাজার ৪৬টি সমিতির
মাধ্যমে ৫২ হাজার ১৭২ জন সদস্যের দারিদ্র্য বিমোচন তথা জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে।
এছাড়া আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৬২৩টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও
পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া ব্যাপকভাবে লেগেছে।
২৩৮টি বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। শান্তিচুক্তির
খন্ড খন্ডের ৩৪ ধারা অনুযায়ী ইতোমধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার ৩০টি বিভাগ, রাঙামাটি জেলার ৩০টি
বিভাগ এবং বান্দরবান জেলার ২৮টি বিভাগ হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘ খন্ডের ১ ধারা অনুযায়ী
ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতীয় শরণার্থী পরিবারকে ইতোমধ্যে প্রত্যাবাসন করা
হয়েছে। প্রতিটি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। ২০ বছর পূর্বে যারা
চাকরি ত্যাগ করেছিল তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। তাদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করার
জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। প্রত্যাবাসিত শরণার্থীদের ভূমি সমস্যার সমাধান
কল্পে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই কমিশনের ৬ষ্ঠ চেয়ারম্যান
নিয়োগ বিবেচনাধীন রয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পিত্তি কমিশন আইন-২০০১ সংশোধন করা হয়েছে। এ
কমিশন কার্যকর করার লক্ষ্যে বিধিমালা তৈরির কাজ প্রক্রিয়াধীন।
উল্লেখ্য যে, শান্তিচুক্তি ৪ খন্ডে বিভক্ত। ক খন্ডে ৪টি, খ খন্ডে
৩৫টি, গ খন্ডে ১৪টি, এবং ঘ খন্ডে ১৯টি মিলে সর্বমোট ৭২টি ধারা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম
বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর তাঁর কার্যালয়ে নিবন্ধ লেখককে দেয়া এক স্বাক্ষাৎকারে
বলেন, ক খন্ডের ১, ২, ৩, ৪ ধারা; খ খন্ডের ১, ২, ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪,
১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ও ৩৩ ধারা; গ খন্ডের ১, ৭, ৮,
৯, ১০, ১২, ১৪ ধারা এবং ঘ খন্ডের ১, ৫, ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৯ ধারা মিলে
মোট ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। খ খন্ডের ৪(ঘ), ৯, ১৯, ২৪, ২৭,৩৪; গ খন্ডের ২, ৩, ৪,
৪, ৫, ৬ এবং ঘ খন্ডের ৪, ১৬, ১৭, ১৮ নম্বর মিলে মোট ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে।
খ খন্ডের ২৬, ২৯, ৩৫; গ খন্ডের ১১, ১৩ এবং ঘ খন্ডের ২, ৩, ৭, ৯ নম্বর ধারা মিলে মোট
৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার মতে, সরকার শান্তিচুক্তির মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন
করেছে। এছাড়াও ১৩টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন করেছে এবং ৩৪টি ধারা অবাস্তবায়িত রয়েগেছে।
তিনি শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে একাধিকবার অসহযোগ আন্দোলনেরও
ডাক দিয়েছেন; একই সাথে এ চুক্তি বাস্তবায়িত না হলে পুনরায় সহিংস আন্দোলন শুরু হতে পারে
বলেও হুমকি দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু সন্তু লারমা মিথ্যা প্রচারণা করছেন বলে দাবি করেছেন
সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার। ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট
নানিয়ারচরে এক সভায় তিনি দাবি করেন, ২০১৩ সালে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভায় ৪৮টি সম্পূর্ণ
বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মতৈক্য পত্রে সন্তু লারমা স্বাক্ষর করেছেন। এই মতৈক্য পত্রে বলা
হয়েছে, অবশিষ্ট ধারাসমূহ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর
পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির পক্ষ থেকে ঢাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি
করা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৩৭টি মৌলিক বিষয় রয়েছে। যার মধ্যে ৪টি পূর্ণ
বাস্তবায়িত, ৯টি আংশিক বাস্তবায়িত এবং ২৪টি অবাস্তবায়িত বিষয় রয়েছে।
শান্তিচুক্তিতে জাতিগত বৈষম্য্
শুরু হয়েছিল। সেই জাতিগত সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে পার্বত্য চুক্তিতে নতুন করে আরো
কিছু সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙালি। কিন্তু
শান্তিচুক্তিতে সেই বাঙালি জনগোষ্ঠীর জাতীয়তা কেড়ে নিয়ে তাদেরকে ‘অ-উপজাতি’ আখ্যা দেয়া
হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতিসত্তার জন্য দীর্ঘ লড়াই করেছে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও ৭২-এর সংবিধানে বাঙালি
জাতীয়তার স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু এমএন লারমাকে বাঙালি হয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
শুধু তাই নয়, তিনিই সর্বপ্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি স্যাটেল করানোর কথা উচ্চারণ
করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর সেই কথার বাস্তবায়ন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট
জিয়াউর রহমান। কিন্তু শান্তিচুক্তি করার সময় আওয়ামী লীগ সেই বাঙালি জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তাকে অস্বীকার করে তাদের
‘অ-উপজাতি’ আখ্যা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছে। শুধু তাই নয় চুক্তির
‘ক’ খন্ডের ১ নং ধারায় ‘উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’
হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙালির অস্তিত্বকে
অস্বীকার করা হয়েছে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়
বিভিন্ন সুবিধায় পার্বত্য উপজাতিদের নানা অগ্রাধিকার শর্তযুক্ত করে বাঙালিদের প্রতি
বৈষম্য করা হয়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় প্রথাগত রীতি অনুসরণের বিধান যুক্ত করায় সেখানে
বসবাসরত বাঙালিরা ভূমিহীন ও বাস্তচ্যুত হবার আশঙ্কায় দিন গুনছে।
জেএসএসও শান্তিচুক্তি পালন করেনি
তাদের সকল অস্ত্র ত্যাগ করবে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। বাস্তবতা হলো, শুরু থেকেই
জেএসএসের সশস্ত্র শাখা এই শর্ত পালন করেনি। শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর অস্ত্র সমর্পণের
দিনই শান্তিবাহিনীর একটি গ্রুপ শান্তিচুক্তিকে প্রহসন
আখ্যা দিয়ে অস্ত্র সমর্পণের বিরোধিতা করে। পরে এ গ্রুপটি ইউপিডিএফ নামে আত্মপ্রকাশ
করে। এদিকে শান্তিবাহিনীর মূল গ্রপটিরও একাংশ অস্ত্র সমর্পণ
না করে ভেতরে রয়ে যায় এ সন্দেহে যে, সরকার প্রতারণা করতে পারে। এ বাহিনী পরে ভেঙে দুই
ভাগে বিভক্ত হয়ে আরেক নতুন গ্রুপের জন্ম হয় জনসংহতি সমিতি(সংস্কার) নামে। শান্তিচুক্তির দুই দশক এই তিন গ্রুপের সশস্ত্র লড়াইয়ের দশক। এই তিন
গ্রুপের হত্যা, খুন ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতন, দখল, পাল্টা দখল, অভ্যন্তরীণ
দ্বন্দ্বের পার্বত্য চট্টগ্রাম এক বিভিষিকাময় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ইউপিডিএফ
ভেঙে নতুন আরেক গ্রুপের জন্ম হয়েছে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পূর্বে শান্তিবাহিনীর সাথে
যুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৪৩ জন সদস্য নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৭৩, বিজিবি
৯৬, পুলিশ ৬৪, আনসার ভিডিপির ১০ জন। নিহত সেনা সদস্যদের মধ্যে অফিসার ৫ জন, জেসিও ৩
জন, বাকিরা সৈনিক। এছাড়াও দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনা, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন
রোগ, ভূমি ধস প্রভৃতি কারণে মারা গেছে অনেকে। এর মধ্যে শান্তিচুক্তির পূর্বে শুধু ম্যালেরিয়ায়
নিরাপত্তা বাহিনীর ১৬০ জন এবং
পরে ৮১ জন মারা গেছে। উভয় কারণে আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুল পরিমাণ নিরাপত্তা বাহিনীর
সদস্য। তবে শান্তিচুক্তির পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর মোট
৯৬ জন সদস্য মারা গেছে। এর মধ্যে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে মারা গেছে ১১ জন, ৫ জন
রাঙামাটির ভূমি ধসে।
শান্তিচুক্তির পূর্বে নিরাপত্তা বাহিনী ১৬ শতাধিক অস্ত্র উদ্ধার
করেছে। এর মধ্যে গ্রেনেড ৩৫৯টি, মর্টার ৭০টি, মাইন ১৩টি এবং অন্যান্য গোলাবারুদ সাড়ে
৪ লক্ষ। পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পরে ২০০৫ সাল থেকে অদ্যাবধি ২৭৩০টি
অস্ত্র ও ১ লক্ষ ৮৬ হাজার গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। এক পরিসংখ্যানে
দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পূর্বে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শান্তিবাহিনী কর্তৃক
২৩৮ জন উপজাতি, ১০৫৭ জন বাঙালি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৮১ জন উপজাতি ও ৬৮৭ জন বাঙালি।
অপহরণের শিকার হয়েছে ২৭৪ জন উপজাতি ও ৪৬৮ জন বাঙালি। একই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শান্তিচুক্তির
পরে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত শান্তিবাহিনী কর্তৃক ৪৭৪ জন উপজাতি, ১৮৬ জন বাঙালি
নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬৪৬ জন উপজাতি ও ৬৪২ জন বাঙালি। অপহরণের শিকার হয়েছে ৯১০ জন
উপজাতি ও ৩৮৪ জন বাঙালি।
পাশাপাশি উপজাতীয় সশস্ত্র গ্রুপ নিজেদের সন্ত্রাসী তৎপরতা
চালাতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে চাঁদাবাজির অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। সেখানে চাঁদাবাজি একটা
সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। ডিম, মুরগী, ফল, সব্জি বিক্রি থেকে শুরু করে সব ধরনের কৃষিকাজ,
ব্যবসা, অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, সব ধরনের পেশার উপর নির্ধারিত হারে চাঁদা ধার্য
করে বছরে প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে থাকে। চাঁদা না দিলে তারা হত্যা, গুম,
অপহরণ, নির্যাতন চালায়। শান্তিচুক্তি করা হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের
প্রতি আনুগত্য পোষণ করে। অথচ জেএসএস সভাপতি প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা ভোগ করার পরও একুশে ফেব্রুয়ারী , শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের মতো জাতীয় দিবসগুলো
পালন করেন না। তিনি এখনো বাংলাদেশের ভোটার হননি বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ।
শান্তিচুক্তিতে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের মূল স্রোতধারা থেকে
সর্বক্ষেত্রে প্রিভিলেজ দেয়া হয়েছে। অথচ এর সুযোগ নিয়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো ও তার সমর্থকেরা
বাংলাদেশের জাতীয় চেতনা, সার্বভৌমত্ব, অখন্ডতা, উন্নয়ন, যুথবদ্ধতার বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক
ও ঘৃণা ব্যাঞ্জক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত। তারা দেশি-বিদেশি ইন্ধনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে
বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে।
নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে দাবি করছে। শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পরপরই সন্তু লারমার পক্ষ
থেকে দাবি করা হয়, শান্তিচুক্তির একটি অলিখিত রূপ ছিলো এবং সেই অলিখিত শান্তিচুক্তিও
বাস্তবায়ন করতে হবে। তাদের সেই দাবি মেনে ভূমি কমিশন আইন-২০০১ এর অধিকতর সংশোধনী ২০১৬
জাতীয় সংসদের পাশ করা হয়েছে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অন্তরায় পূর্বেই বলা হয়েছে, শান্তিচুক্তি ছিল একটি আকাংকা।কিন্তু সেই শান্তিচুক্তিতেই এমন কিছু ধারা সনযোজিত হয়েছে যা সংবিধান ও প্রচলিত বহু আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। একই সাথে তা বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক।
ধারা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছে। এই রিটের রায়ে উচ্চ আদালত শান্তিচুক্তির
অনেকগুলো ধারা অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দিয়েছে। যদিও উচ্চ আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে
স্থগিতাদেশ দেয়া হয়েছে। মামলাটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এদিকে ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আইনের সমন্বয়ের
পথে’ শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালা রাজধানীর একটি আবাসিক হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য ২৬টি
জাতীয় আইন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট ১২টি আইনসহ মোট ৩৮টি আইন সংশোধন
করা প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত বিভিন্ন নিয়ম, প্রবিধান এবং বিভিন্ন সাংগঠনিক
কাঠামোরও সংশোধন করা প্রয়োজন। শান্তিচুক্তির আওতায় গঠিত ভূমি কমিশন আইনের সর্বশেষ সংশোধনীকে
বিশেষজ্ঞরা রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা, কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন। এতে
প্রমাণিত হয়, শান্তিচুক্তির কিছু অংশের সাথে বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের সাংঘর্ষিক
অবস্থান রয়েছে। উপযৌক্ত আলোচনায় প্রমাণিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের
প্রেক্ষাপটে শান্তিচুক্তি ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। তবে চুক্তিকালীন কিছু অসতর্কতা
ও ত্রুটি এখন শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। মানবিক সীমাবদ্ধতার
কারণে মানুষের তৈরি কোনো বিধান একবারে নির্ভুল বা চূড়ান্ত হয় না। সময় ও প্রয়োজনের নিরীখে
তার পুনর্মূল্যায়ন, সংশোধন, পরিবর্তন হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধান সময় ও প্রয়োজনের
দাবিতে সংশোধিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানও ১৬ বার সংশোধিত হয়েছে।
কোনো চুক্তি বা আইন তো আর সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান পেতে পারে না।
কেননা, আইন ও চুক্তি হয়ে থাকে সংবিধানের আওতায়। শান্তিচুক্তিও সেভাবে বাংলাদেশ সংবিধানের
আওতায়ই হয়েছে। সেকারণে শান্তিচুক্তিতে সংবিধান বহির্ভূত বা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক
কোনো কিছু থাকা উচিত নয়। শান্তিচুক্তির দুই দশক পরে আজ সময়ের দাবি শান্তিচুক্তি পুনর্মূল্যায়নের।
তাতে একদিকে সংবিধান, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক যেসব ধারা, উপধারা
দৃশ্যমান হবে তা সংশোধন করা যেতে পারে, অন্যদিকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন বেগবান হতে
পারে এমন ধারা সংযোজনও করা যেতে পারে। আর এ পথেই বইতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত
শান্তির ফল্গুধারা।