
পার্বত্য চুক্তিকে দেশ বিক্রির চুক্তি আখ্যা দিয়ে ক্ষমতায় গেলে চুক্তি বাতিল করা হবে বলে আন্দোলন করলেও বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই মান্নান ভুঁইয়ার নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে, যে কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহম্মদ। বিএনপি সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এলজিইডি, ধর্ম ও সমাজ কল্যাণের মতো ১২টি অধিদপ্তরের কার্যক্রম আঞ্চলিক পরিষদের কাছে হস্তান্তর করে। চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের বর্তমান জিওসি মেজর জেনারেল শামীম কিছুদিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৫ বছরে সর্বমোট ৮৮টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং ২০০৪ সালে সর্বাধিক সংখ্যক ৬৮টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে।
শান্তি চুক্তির এক যুগের পথ পরিক্রমায় সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সকল সীমাবদ্ধতা ও বিতর্ক সত্ত্বে শান্তি চুক্তি বাস্তবতাকে পক্ষ-বিপক্ষ সকলেই মেনে নিয়েছেন। পার্বত্য বাঙালী জনতা ও তাদের সংগঠন সমঅধিকার আন্দোলন একদশক পর্যন্ত পার্বত্য চুক্তি বাতিলের জন্য আন্দোলন করলেও চুক্তির বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে গত ২০০৭ সালের ২ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে চুক্তির পূণর্মূল্যায়ন, সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ধারা বাতিল, এবং চুক্তিতে বাঙালীদের ন্যায্য অদিকারের স্বীকৃতি দাবী করেছে। বর্তমানেও তারা এই দাবীর উপরেই আন্দোলন করছে। অন্যদিকে বর্তমান সরকার পক্ষও চুক্তির মধ্যে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং কিছু বাস্তবায়ন অযোগ্য ধারার অস্তিত্ব মেনে নিয়ে পার্বত্য চুক্তি পূণর্মূল্যায়নের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। সম্প্রতিকালে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান সাজেদা চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষযক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুদদার সংবাদ মাধ্যমের কাছে এ মত ব্যক্ত করেছেন যে, সরকার পার্বত্য চুক্তি পূণর্মূল্যায়নের কথা চিন্তা করছে।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির এক যুগ অতিবাহিতের ফল বিশ্লেষণ করে একথা বলা যায় যে, শান্তি চুক্তি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। চুক্তির ফলে একদিকে যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সন্ত্রাসীর অস্ত্র সমর্পন নিশ্চিত করা যায়নি। উল্টো ইউপিডিএফ নামে নতুন সশস্ত্র সংগঠনের জন্ম হযেছে। চুক্তির ফলে সেনাবাহিনীর সাথে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের যুদ্ধ হার হ্রাস পেলেও সাধারণ মানুষ হত্যা হ্রাস করা যায়নি। বরং সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বরবাসকারী প্রত্যাবাসিত বাঙালীরা শরণার্থির মতো নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। চুক্তির শর্তানুযায়ী সেনা প্রত্যাহার করায় দুর্গম পাহাড়ে বসবাসকারী নিরীহ উপজাতীয়দের নিরাপত্তা সবচেয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। জঙ্গীবাদীরা ট্রেনিং ক্যাম্প হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম ভূখণ্ডকে ব্যবহার করছে। প্রকৃতপক্ষে, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী জেএসএস ও ইউপিডিএফ’র সর্বোচ্চ ১০ হাজার সন্ত্রাসী সদস্য এবং কিছু কুমতলববাজ এনজিও কর্মী। এর বাইরে পাহাড়ের সকল শ্রেণীর বাঙালী ও উপজাতীয় বাসিন্দাগণ শান্তিপ্রিয় ও সহাবস্থানে বিশ্বাসী। শান্তি চুক্তি, স্বাধীন জুম্ম ল্যাণ্ড, সেনা প্রত্যাহার, বাঙালী খেদাও , পাহাড়ী খেদাও কোনো কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই। বরং বর্তমানে বাঙালী-পাহাড়ী সহাবস্থান, সৌহার্দ, সৌজন্যতা, আতিথেয়তা এমনকি বিয়েশাদির মতো আত্মীয়তা বিনিময় হচ্ছে দেদারসে। উল্টো শান্তি চুক্তির ফলে সেই সহজ, সুন্দর, স্থায়ী শান্তির সম্পর্ক ও সহাবস্থানকে কিছু বর্তমান ও সাবেক সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মী হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে শান্তি চুক্তির ছায়ায় খ্রিস্টিয় সাম্রাজ্যবাদ ইউএনডিপির মতো বিশ্ব সংস্থা ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে তাদের পূর্ব তিমুরের ন্যায় খ্রিস্টিয় সাম্রাজ্য বিস্তারের নীল নকশা বাস্তবায়ন করছে নির্বিঘ্নে।