পাহাড় কেটে চলছে হরি লুট, দেখার কেউ নেই

0
56

পার্বত্য জনপদসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়ের নান্দনিক সবুজ ঢেউ থামিয়ে
দেওয়া হচ্ছে কারণে-অকারণে। কোথাও উন্নয়নের নামে, আবার কোথাও মাটিখেকোদের জুলুমে ফোকলা
হচ্ছে এই প্রকৃতির দেয়াল। নতুন স্থাপনা নির্মাণ থেকে সড়ক সম্প্রসারণ বা নানা ছুতায়
কোপ পড়ছে পাহাড়ে। কোনো রকম রাখঢাক ছাড়াই, ফকফকা দিনের আলোতেই চলছে এই পাহাড় লুট। অনেক
এলাকায় পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। পাহাড় লোপাটের সেই গল্পে
উপজাতি নেতাকর্মীরা থাকেন ‘নায়ক, আর স্থানীয় প্রশাসন হয়ে যায় নীরব দর্শক!

শুধুই কি পাহাড়, মাটি লুটের কারণে উজাড় হচ্ছে পাহাড়ি বন। পাহাড় ধসে মাটিচাপায়
নিভছে মানুষের প্রাণ, হারিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি। ইটভাটায় পাহাড়ের মাটি তুলে দিয়ে পাহাড়ি
সন্ত্রাসীরা পকেটে ভরছে টাকা। আর ভাটায় পুড়ে খাক হচ্ছে শত শত বছরের পুরনো পাহাড়ের সোনামাটি।
একের পর এক পাহাড় ন্যাড়া হতে থাকলেও যেন দেখার কেউ নেই।

পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে নির্বিচারে পাহাড় খোদাই চলতে থাকলে
আগামী পাঁচ দশকের মধ্যে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর পাহাড় দেখা যাবে না। পাহাড়
কাটার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ। বন হারাচ্ছে তার চেনা রূপ। এ কারণে
বনের নানা প্রাণী হাঁটছে বিলুপ্তির পথে।

বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে পাহাড়ের আয়তন প্রায় ১৩ লাখ ৭৭ হাজার
হেক্টর, যা মোট আয়তনের ৯.৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে বন অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ছয় লাখ
৭০ হাজার হেক্টর পাহাড়ি বন। তবে তিন পার্বত্য জেলাকে বলা হয় পাহাড়ের আঁতুড়ঘর। এ ছাড়া
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার আর সিলেট অঞ্চলে রয়েছে আরো ছোট-বড় পাহাড়-টিলা। নির্দয়ভাবে পাহাড়
কাটার কারণে এখন পাহাড়ের আয়তন কতটুকু কমেছে তার হিসাব সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার
কাছেই নেই।

১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি,
আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন
পাহাড় ও টিলা কাটা বা মোচন করা যাবে না। তবে শর্ত দিয়ে বলা হয়েছে, অপরিহার্য জাতীয়
স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় বা টিলা কাটা বা মোচন করা যাবে।

নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়মিতই ঘটছে
পাহাড়ধসের ঘটনা। নিকট অতীতে ২০১৭ সালের ১৩ জুন সবচেয়ে প্রলয়ংকরী পাহাড়ধসের ঘটনায় দেশ
দেখেছিল মৃত্যুর মিছিল। সেই বছর বৃহত্তর চট্টগ্রামে এক দিনেই ১৪২ জন এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে
প্রাণ হারিয়েছিল। এদের মধ্যে ১২০ জনই ছিল রাঙামাটির। উদ্ধার তৎপরতা চালাতে গিয়ে মাটিচাপায়
জীবন দিয়েছিলেন পাঁচ সেনা সদস্যও।

পাহাড় কাটা বন্ধে প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ, অথচ পার্বত্য তিন জেলায় সরাসরি
নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়। অভিযোগ পেলে মাঝে মাঝে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা স্বল্প
সময়ের জন্য এসে ঘুরে গেলেও তাঁরা কোথাও পাহাড় খেকো উপজাতি সন্ত্রাসীদের পাহাড় কাটা
বন্ধ করতে পেরেছেন
এমন নজির বিরল!

রাঙামাটির পাহাড়ের মাটির বেশির ভাগই যায় ইটভাটায়। জেলায় যত ইটভাটা আছে,
দুই-তৃতীয়াংশের বেশিই রাঙামাটির সীমান্ত লাগোয়া চট্টগ্রামের রানীরহাট আর রাঙামাটির
কাউখালী উপজেলায়। এক কিলোমিটারের মধ্যে অর্ধশতাধিক ইটভাটার সব মাটিই আসে রাঙামাটির
বিভিন্ন প্রান্তের কাটা পাহাড় থেকেই। আর এগুলোর নেতৃত্বে রয়েছেন পার্বত্য আঞ্চলিক দলের
রাঘব বোয়ালরা।

শুধু কাউখালীতেই নয়, নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, কাপ্তাই উপজেলায়ও চলছে
বিধ্বংসী পাহাড় কাটা। রাঙামাটি শহরের মানিকছড়ি, কুতুকছড়ি, কেরানী পাহাড়, পুলিশ লাইন,
হ্যাচারি এলাকা, মানিকছড়ি, টিভি স্টেশন এলাকা, ভেদভেদী, কলেজ গেট, আসামবস্তি, রাঙাপানিসহ
বিভিন্ন এলাকারও একই ছবি।

লংগদু আটারকছড়া ইউনিয়নে তিন ব্রিজ এলাকায় পাহাড় কেটে দোকানের প্লট তৈরি
করছেন জেএসএস এর সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় কার্বারি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় অভিযোগ
উঠলেও কোনো পদক্ষেপই নেয়নি প্রশাসন।

রাঙামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের পরিচালক হেফাজত সবুজ ক্ষোভ
প্রকাশ করে বলেন, ‘বাড়ি নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার, ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের
জন্য পাহাড় কাটছে একটি চক্র। দিনের আলোয় পাহাড় কাটা চললেও প্রশাসন নির্বিকার।

বান্দরবানের পাহাড়ে ঠিকাদারের লোভী চোখ : এ বিষয়ে বান্দরবান জেলায় খবর নিয়ে
জানা যায়, ব্যক্তিপর্যায়ে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও বান্দরবানে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের
নামে চলছে পাহাড় কাটার মচ্ছব। কখনো সড়ক, আবার কখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণের আড়ালে
পাহাড় কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, লামা, আলীকদম
ও নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ের মাটি চলে যাচ্ছে ইটভাটায়। এক লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নেই
রয়েছে ২৯টি ইটভাটা। এসব ইটভাটায় প্রতি মৌসুমে লাখ লাখ ট্রাক পাহাড়ি মাটি পোড়ানো হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বান্দরবান পৌরসভার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়,
‘খুব একটা প্রয়োজনীয় নয়
এমন একটি প্রকল্পকে জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকার দেখিয়ে এক কোটি
৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কৌশলে এই প্রকল্পের ঠিকাদারও মাটি বেচে বাগিয়ে নিয়েছেন
লাখ লাখ টাকা। ওই সূত্র দাবি করে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করে লাভ করার জন্য নয়, মাটি বিক্রি
করার অসৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার এই কাজটি হাতে নেন। ধারণা করা হচ্ছে,
প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ঠিকাদার যত টাকা লাভ করেছেন, মাটি বিক্রি করে তার দ্বিগুণ লাভ
তুলে নিয়েছেন।

খাগড়াছড়িতে পাহাড় কাটছেন প্রভাবশালীরা : খাগড়াছড়ি থেকে খবর নিয়ে জানা যায়,
খাগড়াছড়িতে দিনেদুপুরে চলছে পাহাড় কাটা। ঘরবাড়ি নির্মাণ, বিভিন্ন উন্নয়নকাজসহ ইটভাটায়
যাচ্ছে এসব মাটি। রামগড় উপজেলার বল্টুরাম টিলা, সোনাইআগা, কালাডেবা, খাগড়াবিল, বলিপাড়াসহ
বেশ কয়েকটি স্থানে কোথাও এক্সকাভেটর, আবার কোথাও ফেলোডার ব্যবহার করে চলছে পাহাড় লুট।
এমনকি কৃষি জমির উপরিভাগের মাটিও কেটে নেওয়া হচ্ছে অবাধে। প্রভাবশালী পার্বত্য সশস্ত্র
সন্ত্রাসীরা সিন্ডিকেট করে এসব অপকর্ম করে গেলেও দেখার কেউ নেই।

পার্বত্যমন্ত্রী যা বললেন : পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর
উশৈসিং এমপি বলেন, ‘বিগত সরকারগুলোর উদাসীনতার কারণে যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে ছিল এই অঞ্চল।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের অন্যান্য এলাকার মতো সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়ায় এই
অঞ্চলে গত ১২ বছরে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকেই।
পাহাড়ি এলাকায় সড়ক যোগাযোগ, পানি সরবরাহ প্রকল্প, হাসপাতাল, স্কুলসহ যেকোনো অবকাঠামো
নির্মাণ করতে গেলে পাহাড় কাটা বা ভূমিরূপে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়। তবে আমাদের খেয়াল
রাখতে হবে পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশে যেন বড় ধরনের বিপর্যয় না ঘটে। তিনি আরো বলেন,
যেকোনো মূল্যে আমাদের পাহাড় রক্ষা করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পাহাড়
কাটা যতটা সম্ভব কমানো যায়, এ ব্যাপারে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে
নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here