কল্পনা চাকমার সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের শুরুতেই জানতে হবে কে এই কল্পনা চাকমা? কি তার পরিচয়? আসুন জেনে নেই কে এই কল্পনা চাকমা যাকে ঘিরে এই পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৫ বছর ধরে চলছে অপহরণ নাকি অন্তর্ধান এই নিয়ে গুঞ্জন। কল্পনা চাকমা শান্তিবাহিনীর একটি অঙ্গসংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) এর সাংগঠনিক সম্পাদিকা ছিলেন। রাজনীতি, আন্দোলন, এবং নেতৃত্বে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পাহাড়ি মেয়েদের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি কাজ করতেন। কল্পনা চাকমার এক দূর সম্পর্কের আত্নীয় অরুণ বিকাশ চাকমা ভারতের অরুণাচল প্রদেশের ভারতীয় যুব কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। অরুণ কয়েকবার কল্পনাদের বাড়ীতে বেড়াতেও এসেছিল। দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও পারিবারিকভাবে বিষয়টি মেনে নেয়া হয়নি। তাই, তৎকালীন শান্তিবাহিনী আর পিসিপি’র সহায়তায় অরুণ বিকাশ কল্পনাকে অপহরণ করে, যা অনেকটা স্বেচ্ছায় অপহরণের নামান্তর বলা যেতে পারে। বিষয়টি তার পরিবারের সকলেই জানেন। ১৯৯৬ সালের বেশ কয়েকটি পত্রিকায় বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করা হয় যে, কল্পনা চাকমা অপহরণ বিষয় সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য, দলিল, এবং সাক্ষ্য প্রমাণে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, কল্পনা চাকমা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসীদের চক্রান্তে নিখোঁজ হওয়ার নাটক সাজিয়েছেন। ৮ আগস্ট ১৯৯৬ সালে, জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার সরজমিন তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয় যে, কল্পনা চাকমা ঐ সময় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গংগাছড়া মহকুমার ৪ মাইল পূর্বে ‘শুক্রে’ নামক স্থানে তাকে দেখা গিয়েছিল। পরেরদিন ৯ আগস্ট ১৯৯৬ সালে বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকায় তদন্ত কমিশনকে জানায় কল্পনা চাকমার বেঁচে থাকা এবং অপহরণের সাথে নিরাপত্তাবাহিনী জড়িত নয় বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তদন্ত কমিশন অনেক পাহাড়ী, বাঙ্গালী, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার সাক্ষ্য নিয়ে ভিডিও ক্যাসেট, রেকর্ডার ও বিভিন্ন দালিলিক প্রমাণাদি উপস্থাপন করেন। রাংগামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার লাইল্যাঘোনায় কল্পনা চাকমার বাড়িতে তার মা মাধবী চাকমা ছাড়াও চাচাতো বোন ছবিময় চাকমা, প্রতিবেশি কৃষ্ণমোহন চাকমা, শান্তিবাহিনীর হিরো চাকমা, নিশি কুমার, প্রতিবেশি পিসিপি’র দেবাশীষ ও প্রতিবেশী সতীশ কারবারীসহ এলাকার উপস্থিত আরো অনেকের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে কল্পনা চাকমার মায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে, ১১ জুন দিবাগত রাত ২ টার দিকে ১০/১২ জন লুঙ্গি পরিহিত সশস্ত্র লোক দূর থেকে কল্পনাকে ডাকতে ডাকতে ঘরের কাছে আসে এবং দরজা কেটে ভিতরে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর কল্পনার বড় ভাই কালেন্দ্র কুমার চাকমাকে নিয়ে ঘরের পশ্চিম দিকে বিলের সামনে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফিরে আসে এবং কল্পনাসহ তার দুই ভাই কালেন্দ্র কুমার চাকমা এবং খুদিরাম চাকমাকে (লালবিহারী চাকমা) নিয়ে ঘর থেকে চলে যায়। চলে যাওয়ার সময় তিনি ২টি গুলির শব্দ শোনেন। প্রায় ২ ঘন্টা পর কল্পনার দুই ভাই মা মা বলে চিৎকার করতে করতে অক্ষত অবস্থায় ঘরে ফিরে আসে এবং কল্পনা চাকমাকে নিয়ে গেছে বলে জানায়। তিনি আরো জনিয়েছিলেন যে, কণ্ঠস্বর শুনে তার মনে হয়েছিল যে তারা সশস্ত্র বাহিনীর লোক। তিনি আরো বলেন যে, লে. ফেরদৌসকে তিনি কখনো দেখেন নি। তদন্তকালে প্রতিবেশিরা কল্পনা চাকমার অপহরণের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেনি। এমনকি, তারা কেউ ঐ রাতে গুলির শব্দ শোনেন নি বলে জানান।
এ থেকেই বুঝা যাই যে, কল্পনা চাকমার পরিবারের লোকজন গুলির শব্দের ব্যপারটা মিথ্যা বলেছিলেন। এমনকি কল্পনা চাকমার বড় ভাই পরের দিন ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। ওনার বড় ছোট বোন অপহরন হওয়ার পরও কল্পনা চাকমার ভাইদের মানসিক অবস্থা এতটায় ভাল থাকার কথা না যে, ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে কালিন্দ্রনাথ চাকমা ভোট দিবেন। কমিশন জানায় যে, কল্পনা চাকমার মা শিকার করেছেন যে, উক্ত ঘটনার পর কল্পনা চাকমা তার মায়ের সাথে দুইবার যোগাযোগ করেছিল। এর মধ্যে সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছে ১ আগস্ট ১৯৯৬। তদন্তকালে, যখন কল্পনা চাকমার মাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, কল্পনা চাকমাকে নিয়ে যাওয়ার পরে তিনি বা তার পরিবারের অন্যরা রাতেই কেন আশেপাশের লোকজনকে বলেননি বা কোন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেননি– এর উত্তরে তিনি চুপ ছিলেন। উল্লেখ্য যে, কল্পনা চাকমার চার ভাইয়ের মধ্যে আরো দুই ভাইয়ের বাড়ি কল্পনা চাকমার ঘরের প্রায় একশ’ গজের মধ্যেই ছিল। তন্মধ্যে অভিজিত কুমার চাকমার বাড়ির কাছেই ছিল গোসলের ঘাট যেখানে দুই ভাইয়ের উপর গুলিবর্ষণ ও কল্পনা চাকমার চিৎকারের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তারাও কেউই রাতে গুলির শব্দ বা কল্পনার চিৎকার শুনতে পায়নি। বরং সে পুরো ঘটনা জানতে পারে ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পর। এ থেকেই ষ্পষ্টত যে, কল্পনা চাকমা আসলে অপহরন হয়নি বরং সেচ্ছায় অন্তর্ধান নিয়েছে সন্ত্রাসী সংগঠন এর সহযোগীতায়। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, নির্বাচনের আগের রাত বলে কল্পনা চাকমাদের বাড়ি থেকে ৬০০/৭০০ গজ দূরে স্কুলে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে আসা অনেক বেসামরিক লোক ছিল, কিন্তু তাদের কেউই কোন গুলির শব্দ শুনেনি।
অর্থাৎ, গুলির কোন ঘটনা আদৌ ঘটে ছিল কিনা – তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এখানেও বলা যেতে পারে যে, কল্পনা চাকমা অপহরণ হয়নি, বরং অন্তর্ধান হয়েছিল। লেঃ ফেরদৌস নিরঅপরাধ বরং সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই পাহাড়ি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী কল্পনা চাকমার সেচ্ছায় অন্তর্ধান কে সেনাবাহিনী কর্তৃক অপহরনের নাটক সাজিয়েছিল। সেনাবাহিনী বরং কল্পনা চাকমার সন্ধান প্রদানকারী ব্যাক্তিকে ৫০,০০০/- টাকা পুরষ্কার ঘোষনা করে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে লিপলেট বিতরন করেছিল। এত তথ্য প্রমাণ কি যথেষ্ঠ নয়? যে কল্পনা চাকমা অপহরণ হয়নি বরং সন্ত্রাসী সংগঠনের মদদে তাকে তার স্বামীর কাছে দেশান্তরীত হতে বাধ্য করেছে? এই প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম বাংলার সচেতন নাগরিকদের কাছে এবং সেই সাথে যারা কল্পনা চাকমার অপহরণ নিয়ে লাফালাফি করেন তাদের কাছে।