জনসংখ্যার
সুষম বন্টন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের
উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার সত্তরের দশকের শেষদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভূমিহীন ও দরিদ্র মানুষদেরকে
এনে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম উপত্যকা এলাকায় সরকারি খাস জমিতে পুনর্বাসন করে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠন করার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও এর সশস্ত্র
সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতলের বাঙ্গালীদের এই পুনর্বাসন মেনে
নেয়নি। এই পুনর্বাসন এর
ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের সাথে বাঙ্গালীদের জনসংখ্যা ভারসাম্যের সমীকরণ কিছুটা বদলে যাওয়ায় উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা শুরু থেকেই বাঙালি পূনর্বাসনের বিরোধিতা করতে থাকে। তারা এই পুনর্বাসন বন্ধ
করার জন্য এবং পুনর্বাসিত ও স্থানীয় বাঙালিরা
যাতে পাহাড় ছেড়ে সমতলের চলে যায় সে কারণে ধারাবাহিকভাবে
একের পর এক পাহাড়ে
বাঙালি গণহত্যা কান্ডের ঘটনা পরিচালিত করতে থাকে। পার্বত্য দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা হঠাৎ করে কোন বাঙালি গ্রামে আক্রমণ করে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ করে গ্রামটিকে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করেছে বারবার। এভাবেই পাহাড়ে একের পর এক গণহত্যার
ঘটনা ঘটেছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক ছিল রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার ভূষণছড়া গণহত্যা।
বিশ্বের
ইতিহাসে একরাতে এত বড় গণহত্যার
নজির খুব বেশি নেই। ১৯৮৪
সালের ৩০ মে দিবাগত
ভোর চারটায় অর্থাৎ ৩১ মে ভোর
চারটা থেকে শুরু করে সকাল আটটা পর্যন্ত উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা ভূষণছড়া বাঙালি গ্রামে একযোগে হামলা করে প্রায় চারশত বাঙালিকে হত্যা করে এবং এই ঘটনায় সহস্রাধিক
বাঙালি আহত হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় তিন শতাধিক বাঙালি ঘরবাড়ি।
তৎকালীন
সামরিক শাসনামলে গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপিত থাকায় গণমাধ্যমগুলো এত বড় ঘটনা
কোন রিপোর্ট করতে পারেনি। এছাড়াও ঘটনাটি প্রকাশ হলে উপজাতীয়রা ভয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে পারে এই অজুহাত দেখিয়ে
তৎকালীন সরকার এই ঘটনাটিকে ধামাচাপা
দিয়ে ফেলে। তৎকালীন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কারণে কোনো সাংবাদিকদের পক্ষেও ঘটনাস্থলে গিয়ে সঠিক পরিস্থিতি তুলে ধরার মতো বাস্তবতা ছিলনা সেসময়।
কিন্তু
এই ঘটনার পরে বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা উপজাতীয় গ্রামে হামলা করলে কয়েকজন উপজাতীয় গ্রামবাসী হতাহত হয়। উপজাতিদের পক্ষে মিডিয়ার সরকারি সেন্সরশিপ এড়িয়ে বিদেশের মাটিতে বসে বাঙ্গালীদের
আক্রমণের ঘটনাটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন
গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ করে। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে ভূষণছড়ায় পাহাড়ীদের গণহত্যার বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে, পাহাড়িদের একতরফা ও অতিরঞ্জিত প্রচারণা
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় এবং সেই সূত্রে বিভিন্ন লেখকদের লেখা ও গবেষণায় প্রকাশিত
ও ডকুমেন্টেশন হয়। আড়ালে পড়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দিনে সবচেয়ে
ভয়ঙ্কর ও বর্বরতম এক
গণহত্যার কথা।
ঘটনার
পর তৎকালীন সরকার প্রধান রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নিহত ও আহত এবং
অন্য ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ বাঙালিদেরকে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন এর
কথা ঘোষণা করলেও নামকাওয়াস্তে কিছু নগদ টাকা দেয়া ছাড়া আর কোনো পুনর্বাসন
করা হয়নি। কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালিরা।
এমনকি এই ঘটনায় বরকল
থানায় মামলা করতে গেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কথা বলে বরকল থানা সেসময় বাঙ্গালীদের মামলা গ্রহণ না করে একটি
জেনারেল ডায়েরি করে রাখে। বাঙালিরা বারবার মামলা করার চেষ্টা করলেও পুলিশ কোনো মামলা গ্রহণ করেনি। ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম ও বর্বরতম গণহত্যার
বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে
যায়।
হতাহত
ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বিচার এবং ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন না
পেয়ে অনেকেই এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয় অন্যদিকে এ ঘটনার সাথে
জড়িত উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা যারা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল সরকার তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ জমি, রেশন, ঘরবাড়ি, চাকরি ব্যাংকঋণ দিয়ে নানাভাবে পুনর্বাসিত করেছে। এমনকি এই ঘটনার সাথে
নেতৃত্বদানকারী তৎকালীন শান্তিবাহিনীর সামরিক কমান্ডার মেজর রাজেশ ওরফে মনিস্বপন দেওয়ান শান্তি চুক্তির আওতায় সাধারণ ক্ষমা পেয়ে, নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য এবং প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা উপভোগ করেছে। কিন্তু নিহত–আহত ঘরবাড়ি ছাড়া তথা সর্বহারা বাঙালিরা কিছুই পায়নি। তাদের লাশ যে গণকবরে দাফন
করা হয়েছিল সেই গণকবরও যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি।
গণহত্যার ৩৭ বছর পরও
ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালিরা তাদের নিহত স্বজনের হত্যার বিচার চেয়ে শীর্ষ স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে
দ্বারে ঘুরছে, তারা সরকারের প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন চায়।
বাঙ্গালীদের
দাবি শান্তি চুক্তির আওতায় শান্তি বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমা করা হলেও ফৌজদারি অপরাধের মামলার ক্ষমা হতে পারে না। তাদের মতে, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনায় সরকার রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও যে সমস্ত রাজাকার
ফৌজদারি অপরাধ করেছিল তাদেরকে ক্ষমা করেনি। ফলে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর
৭১ সালের যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দিয়েছে বর্তমান সরকার।
একইভাবে
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদেরকে ইন্ডেমনিটির মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে সংবিধান সংশোধন করলেও উচ্চ আদালতের রায়ে সেই ইন্ডেমনিটি বাতিল করে জাতির পিতা হত্যাকারীদের বিচার করা হয়েছে। সেই বিচারে শান্তি চুক্তি কোনো সাংবিধানিক ও আইনগত বিষয়
নয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সমস্ত উপজাতীয়
সন্ত্রাসীরা শান্তিচুক্তির পূর্বে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের মতো
অপরাধের সাথে জড়িত তাদের বিচার করতে কোনো আইন গত বাধা থাকার
কথা নয় । তাই ভূষণছাড়ায়
নিহত–আহত বাঙালি পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বজনদের হতাহতের ঘটনার যথোপযুক্ত বিচার দাবি করছে এবং একই সাথে সরকারের প্রতিশ্রুত পূরণ এবং তাদেরকে নিজ ভূমিতে পুনর্বাসন করার জন্য জোরালো দাবি জানিয়ে আসছে।